শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮ পূর্বাহ্ন
সিলেট প্রতিবেদক: এবারের সিলেট সিটি নির্বাচন যেন নাটকীয়তায় ভরা এক রঙমঞ্চ। নাটকের মঞ্চায়ন, দৃশ্যায়ন ও গল্পের পুরোটাজুড়ে দুই প্রধান দল। শুরুর নাটক ছিলো আওয়ামীলীগের প্রার্থী নিয়ে, মাঝখানে জাতীয় পার্টির, আর শেষের নাটকীয়তা কেবল বিএনপিকে ঘিরে।
আওয়ামীলীগের মেয়র প্রার্থী নিয়ে কত জল কত দিকে গড়ালো। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা কয়েকবছর ধরে নগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দাপিয়ে বেড়ালেন। মিসবাহ সিরাজ, আসাদ উদ্দিন, অধ্যাপক জাকির, আজাদুর রহমান আজাদ ও কামরার পুত্র শিপলুসহ অন্তত: ১০ জন নিজেদের প্রার্থীতা নিয়ে দৃঢ়তা দেখালেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে তাদের তৎপরতা, বক্তৃতা-বিবৃতিও ছিলো নজর কাড়ার মতো। কিন্তু কে পাচ্ছেন মনোনয়ন-এ নিয়ে একেকবার একেকজনের দিকে পাল্লা ভারী হলো। নানাজনের কাছ থেকে নানা খবর বের হলো। দলের ভেতরে মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ পাল্টালো। নাটকীয়তায় ভরে উঠলো নির্বাচনী মাঠ। খবর বেরোলো আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেট সিটিতে দলের মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন। শুরুতেই সিলেট আওয়ামী লীগ বিশ্বাসই করতে পারেনি খবরটি। অবশেষে সেই খবরই সত্যি হলো। ১৫ এপ্রিল সব নাটকীয়তার অবসান ঘটান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঘোষণা করলেন আনোয়ারুজ্জামানের নাম। মনোনয়নের পূর্ব পর্যন্ত দলীয় নেতাদের পিছুটান ছিল। প্রার্থিতা নিয়ে মুখোমুখি ছিলেন আনোয়ারের। এমনকি কেউ কেউ মুখ দেখাদেখিও বন্ধ করে দেন। তবে- আনোয়ারুজ্জামান মনোনয়ন পাওয়ার পর নাটকীয়ভাবে সেই নেতারা এখন তার পক্ষে মাঠে।
ওদিকে, মনোনয়নকে কেন্দ্র করে যখন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে চলমান নাটকীয়তার সমাপ্তি হয় তখন শুরু বিএনপির প্রার্থীতা নিয়ে। সেই নাটকের শুরুর রচিয়তা সিলেট বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও চার বারের জনপ্রিয় কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। ১৮ মে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দিলেন, এবারের নির্বাচন তিনি বর্জন করছেন। এক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্তই তার সিদ্ধান্ত।
এরপর এ নাটকের পূর্ণতা দেন খোদ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলো নানা বিশ্লেষণ। কী করতে পারেন আরিফুল হক চৌধুরী। প্রার্থী হবেন কী, হবেন না- এই জল্পনার মধ্যে রহস্য জিইয়ে রাখলেন আরিফুল হক চৌধুরী নিজেই। ১ মে দিলেন মেসেজ। বললেন, ২০ মে ঘোষণা করবেন তার অবস্থান। সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য সময় দিলেন ২০ দিন। এরপর থেকে প্রায় নীরব ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। নির্বাচনে তার মুভমেন্টও ছিলো কম। সিটি করপোরেশনের রুটিন কর্মকান্ডে অংশ নিলেও তার মুখে ছিলো কুলুপ। তবে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডে গুঞ্জন ও নগরবাসীর কৌতূহল বাড়িয়েছিলো বেশ। কেউ কেউ বলেন, সরকারের ইংগিত পেলে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে আরিফ প্রার্থী হবেন। আবার কেউ কেউ বলেন, ইভিএমে ভোট হওয়ায় এবার ঝুঁকি নেবেন না সিলেটের রাজনীতির এই সুচতুর পুরুষ। আরিফের শেষ নাটকের অপেক্ষায়ও সিলেটের মানুষ। শেষ পর্যন্ত ২০ মে নির্ধারিত দিনেই নগারিক সভায় ঘোষণা দিলেন, নির্বাচনে যাচ্ছেন না তিনি। তবে তার আগের দিন আরেকটি নাটকের ঘটনা ঘটে। নাগরিক সমাবেশের প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েছিলেন তিনি। এ সময় রেজিস্ট্রারি মাঠে প্রবেশ করতে না পেরে গেটের সামনে বসে পড়েন তিনি। সেখানে এক ঘণ্টা অবস্থানের পর তার তিনি দাবি আদায় করেন।
নাটকীয়তার এখানেই শেষ নয়। আরিফুল হক চৌধুরীর ঘোষণার পর বিএনপিতে গত দুই দিন ধরে ঘটেই চলেছে নানা ঘটনা। সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য মাঠে ছিলেন এমন ১০-১২ জন নেতা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। গতকাল সোমবার নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপিদলীয় কাউন্সিলর দিনার খান হাসু। তিনি সিসিকের ১৯ নং ওয়ার্ডের ৩ বারের সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র। তিনি মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক ও ১৯ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।
এর আগে শনিবার নগরীর ৯ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিএনপি নেতা আমির হোসেন প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নতুন অন্তর্ভুক্ত টুকেরবাজারের একটি ওয়ার্ডরে সম্ভাব্য প্রার্থী সিলেটে জেলা ছাত্রদলের সভাপতি আলতাব হোসেন সুমন নির্বাচন থেকে সরে এসেছেন। ২২ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও মহানগর বিএনপি নেতা সৈয়দ মিসবাহ উদ্দিনও প্রার্থী হচ্ছেন না। বিএনপির আরো অনেকেই আজও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামীলীগ-বিএনপির মাঝে জাতীয় পার্টিতেও ঘটেছে নানা ঘটনা। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগর আহ্বায়ক ও শিল্পপতি নজরুল ইসলাম বাবুল। কিন্তু এবার মনোনয়ন চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সদস্য মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। তাকে মনোনয়ন বোর্ড না ডেকেই বাবুলকে প্রার্থী ঘোষণা করায় বেঁকে বসেন তিনি। মাহবুবুর রহমান চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন ডেকে কোটি টাকায় দলীয় মনোনয়ন কেনা হয়েছে বলে দাবি করেন। এ নিয়ে সিলেট জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে তোলপাড় হয়। ঘটে নানা নাটকীয়তা।
আওয়ামীলীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রার্থীতা নিয়ে এতসব নাটকের মাঝে আজ শেষ হচ্ছে মনোনয়ন দাখিলের সময়সীমা। এখন দেখার পালা ২১ জুনের আগে আর কি নাটকীয়তা অপেক্ষা করছে সিলেট সিটি নির্বাচনকে ঘিরে।
গতকাল পর্যন্ত মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ৪৬৬ সংগ্রহ করেছেন মনোনয়নপত্র। এরমধ্যে মেয়র পদে ১১, সাধারণ ওয়ার্ডে (পুরুষ) ৩৬২ ও সংরক্ষিত (নারী) ওয়ার্ডে ৯৩ জন কিনেছেন মনোনয়ন।