শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন
কুলাউড়া প্রতিনিধি : দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের ফানাই নদী খননের কাজে চরম অব্যস্থাপনা, উদাসীনতা ও কাজের ধীরগতির কারণে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারি ১৭ কোটি টাকা।
জলাবদ্ধতা নিরসণের পাশাপাশি হাওর পাড়ের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ফানাই নদী খননে ১৭ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রকল্পের কাজের ফলে উপকারের বদলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাওর পাড়ের মানুষ। নদীর উজান-ভাটি দুইটি অংশে বিভক্ত মোট প্রায় ৪০ কিলোমিটার অংশ খননের ক্ষেত্রে ভাটি অংশের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ এবং উজান অংশের কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের নভেম্বর মাসে তবে কাজ হয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ।
জানা যায়, ২০১৯ সালে কাজ শুরু হয়ে চলতি বছরের মার্চে ভাটি অংশের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। কাজ পায় ঢাকার মেসার্স মা-বাবা কন্সট্রাকশন ও শরিফ এন্ড সন্স ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তবে কাজ শেষ হয়েছে ৭০/৭৫ ভাগ। ইতি মধ্যে ৫০ শতাংশ টাকা উত্তোলন করেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এদিকে উজান অংশের কাজের মেয়াদ আগামী নভেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কাজ পায় এসএএসআই এন্ড ইশতাত এন্টারপ্রাইজ ও জুয়েল ব্যান্সার নভপস ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তবে ইতি মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৬০/৬৫ ভাগ। ৪০ শতাংশ টাকা উত্তোলন করেছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
হাওর পাড়ের মানুষের অভিযোগ, ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী কোথাও কাজ হয়নি। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন হাওর পাড়ের কয়েক লক্ষ মানুষ। সাধারণ মানুষ তাদের ভোগান্তি নিরসণের জন্য একাধিকবার প্রতিবাদ করলেও আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সচেতন মহল বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক তদারকির অভাব ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নামকাওয়াস্তে কাজ করে বিল উত্তোলনের পাঁয়তারা করছে। ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী কাজ না হলে উপকারের পরিবর্তে কৃষকদের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে এমন আতংকে রয়েছেন হাওর তীরবর্তী বাসিন্দারা।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ফানাই নদী খনন প্রকল্পের কাজ হাতে নেয় মন্ত্রণালয়। ৪০ কিলোমিটার খননে প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে (ভাটি অংশ) হাকালুকি হাওরের চকিয়া বিল থেকে ব্রাক্ষণবাজার ইউনিয়নের কাকিচার গ্রাম পর্যন্ত সাড়ে ২৩ কিলোমিটার খনন ও নদীর দুই পাশ ড্রেজিং করে জলজ বৃক্ষ রোপনে বরাদ্দ দেয়া হয় ৭ কোটি ৭৪ লক্ষ ১৯ হাজার ১৬ টাকা। উজান অংশে ব্রাক্ষণবাজার ইউনিয়নের কাকিচার হতে কর্মধা ইউনিয়নের পাহাড়ি এলাকা মহিষমারা পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটারে বরাদ্দ দেয়া হয় ৯ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা।
হাকালুকি হাওরে গেলে দেখা যায়, হাওরের দুগাঙ্গা পয়েন্ট (চালিয়া) থেকে ফানাই নদীর নিচের অংশের খনন কাজ নামকাওয়াস্তে করা হয়েছে। মাটি খননের যন্ত্র ধারা নদীর দুই পাশ থেকে কিছু মাটি উত্তোলন করে পাড়ে এলোপাতারি ভাবে ফেলে রাখা হয়। এতে কৃষক, মৎসজীবি, রাখাল ও পর্যটক সহ সর্বস্তরের মানুষের যাতায়াতে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিগত বোরো মৌসুমে ধান ঘরে আনতে কৃষকদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। অনেকের ফসলি জমিতে মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। এদিকে পুরো নদী খনন না করায় নৌকা চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও দেখা গেছে নদীর অনেক অংশ খননই করা হয়নি। ভাটি অংশে ৯ হাজার ৪’শ জলজ বৃক্ষ রোপনের কথা থাকলেও সরজমিনে একটি গাছও দেখা যায়নি।
তবে দায়িত্ব প্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার আলম জানান, ২ হাজার ২’শ গাছ লাগানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই দৃশ্য ফানাই নদীর জাব্দা, ছিলারকান্দি, ছকাপন, কাদিপুর, চুনঘর ও খাকিচার অংশেও। ভুকশিমইল ইউনিয়নের রিয়াজুর রহমান জানান, নদীর দুই পাশে মাটি স্তুপ করে এলোমেলো ভাবে রাখা হয়েছে। ফলে মাটি ফের নদীতে এবং পার্শ্ববর্তী ফসলি জমিতে পড়ে যাচ্ছে। এতে করে সাধারণ কৃষকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার এলোমেলো করে মাটি রাখায় সাধারণ মানুষের যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, নদী পাড়ের কোথায়ও পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যার কারণে চাষাবাদের মৌসুমে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। কাজের গাফিলতির কারণে এতো টাকা খরচ করেও প্রধানমন্ত্রীর এ বিশেষ প্রকল্প মানুষের কোনো কাজে আসছে না।
হাওর পারের কৃষক আজমল মিয়া, বশির মিয়া, আব্দুল বারী, খালেদ আহমদ, জয়নাল মিয়া ও মতলিব মিয়া বলেন, অগোছালো ভাবে মাটি ফেলে রাখায় যাতায়াতে সমস্যা হয়। গবাদিপশু কিংবা কৃষি পণ্য নিয়ে আমরা হাওরে নামতে পারি না। নদীর পুরো অংশ (প্রস্থ) খনন না করায় নৌকা চলাচলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
হাকালুকি হাওর তীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, ফানাই নদীর অনেক স্থান আছে খননই করা হয়নি। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদ শেষ। একাধিকবার তাদের বলার পরেও কথাগুলো আমলে নেয়নি। কোথাও মাটি ফেলে রাখা হয়েছে আবার কোথাও নেই। এতে হাওর পাড়ের মানুষরা চরম দূর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। অসম্পূর্ণ কাজ করে দেয়ার তাগদা দিলেও তারা কোন পাত্তা দিচ্ছে না। আদৌ কতটুকু করে দিবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার দাবি, ফানাই নদী খনন কাজ তদন্ত করে ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী কাজ করার জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হোক।
মেসার্স মা-বাবা কন্সট্রাকশনের প্রোপ্রাইটর হাসান মোল্লা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করে দুই টাকা লাভমান হওয়া কষ্টকর। মোটামুটি ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করেছি। কোথাও মাটি কম আবার কোথাও মাটি বেশি থাকার কারণে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। এবিষয়ে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান জানান, যতটুকু কাজ হয়েছে সেই পরিমান টাকা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। সর্বাবস্থায় প্রকল্পের কাজ দেখভাল করার জন্য অফিসের দু’জন লোক ছিলেন। এখানে দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই।