মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪২ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট :: ছয় হাজার ব্রয়লার মুরগি নিয়ে খামার গোপাল চন্দ্রের। পুরনো পোল্ট্রি ব্যবসায়ী গোপাল সাভারে বেশ প্রসিদ্ধ। এ ব্যবসার খুঁটিনাটি দিক তার রপ্ত। আশুলিয়ার বাঁশবাড়ি এলাকায় পৈতৃক জমিতে বিশাল খামার গড়ে তুলেছেন গোপাল। তার দেখাদেখি প্রতিবেশী স্বজন জ্যাঠাতো ভাই কেশব মণ্ডলও ব্রয়লার মুরগির খামার করেছেন। এই অঞ্চলে আরো ১০-১৫ জন ছোট-বড় খামারি রয়েছে। তবে ২০ বছরের খামারে বিনিয়োগের তুলনায় লাভ অনেক কম হয়েছে বলে দাবি গোপালের। বাচ্চা ও বড় মুরগির দাম নিয়ন্ত্রণে না থাকায় খামারিরা প্রকৃত লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া খাবারের দাম বৃদ্ধিও এর কারণ। আর এর প্রভাবে বাজারেও।
মাঝে মধ্যেই উঠানামা করতে থাকে পোল্ট্রির দাম। খামারিদের ভাষ্য, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি পোল্ট্রি ব্যবসার সাথে যুক্ত। যারা নিজেরাই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো ও খাবার তৈরি করেন। যখন তখন বাচ্চার দাম ১০-২০ টাকা বৃদ্ধি, প্রাপ্ত বয়স্ক মুরগির দাম ২০-
৩০ টাকা কমানো ও পোল্ট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধি করে বড় এসব কোম্পানি। যেমন- কাজী ফার্ম বাচ্চার প্রোডাকশন করে তারাই দাম নির্ধারণ করেন। আর সিপি ফুড তাদের রেঁস্তোরায় মুরগি বিক্রি করে বিধায় তারা বাজারে এর দাম নিয়ন্ত্রণ করেন। বাজারে এরকম আরো কোম্পানি আছে। তাদের দাবি, বাজারে সব পণ্যের দর নির্ধারণ থাকলে মুরগির বাচ্চা বিক্রির ক্ষেত্রেও থাকা উচিত। কেজি প্রতি মুরগি বিক্রির ক্ষেত্রেও দর নির্ধারণ করা দরকার। এছাড়া সরকারিভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর ব্যবস্থা করলে সাধারণ খামারিরা তুলনামূলক কম দামে কিনতে পারতেন। এতে তারা লাভবান হতেন বলেও আশাবাদী।
সাভারের বিভিন্ন বাজারের পোল্ট্রি মুরগি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে ব্রয়লার ১৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে ১৫ দিন আগে ব্রয়লার ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। বাজারে এখন সোনালি মুরগির দাম সবচেয়ে বেশি। কেজি প্রতি সোনালি ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা অতীতের বাজারে সবোর্চ্চ ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী মো. শাহীন বলেন, “বাজারে মাঝে মধ্যেই মুরগির দাম উঠানামা করে। ১৫ দিন আগে ব্রয়লার মুরগি ১৬০ টাকা কেজি বেচছি। এখন দাম কমছে। তবে সোনালি মুরগির দাম অনেক বেশি। ৩২০ টাকা কেজি আমরা বেঁচতাছি। আমার ব্যবসার লাইফে কোনো দিন সোনালি মুরগির দাম এত হয় নাই। সর্বোচ্চ ২০০ টাকা কেজিতে আমরা সোনালি বেচছি।”
বাজারে মুরগির দাম এত ওঠানামা করার কারণ সম্পর্কে এই ব্যবসায়ী বলেন, “মুরগির খাবার আর বাচ্চার দাম অনেক বেশি। এগুলার দামও কম বেশি হয়। আর আমরাতো সরাসরি খামারির কাছে মুরগি কিনি না। রাতে পিকআপ ভ্যানে করে মুরগি আমাদের দিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। কেজি প্রতি আমরা ১০-১৫ টাকা লাভ করি।”
বাঁশাবাড়ি এলাকার খামারি গোপাল মন্ডল বলেন, ২০০০ সালে ২০০ মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেন তিনি। তখন দিকে ১৫-১৬ টাকা দরে এক দিন বয়সী বাচ্চা কিনেছিলেন। গাজীপুর, রংপুর ও দিনাজপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা বাচ্চা কেনেন। প্রথম অবস্থায় বাচ্চা পাওয়া যেত না। তিন-চার মাস আগে অর্ডার দিয়ে রাখতে হতো। এজন্য হ্যাচারি মালিকদের অনেক সময় অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখতে হতো।
ব্রয়লারের বাচ্চার দাম বাজারে যখন তখন বৃদ্ধি হয় আবার কমে। কোনো সময় ৭২-৮০ টাকা আবার কখনো ৫-৬ টাকা দরেও তিনি বাচ্চা কিনেছেন। করোনাকালীন সময়ে সেই বাচ্চা ২-৩ টাকাতেও কিনেছেন খামারিরা।
ওই সময় কেউ মুরগি কিনতো না। তাই মুরগির কেজি প্রতি দর ছিল ৫০-৬০ টাকা। আবার যখন কেজি প্রতি মুরগির দর ভালো ছিল, তখন বাচ্চার দর বেড়ে ২৮-৩০ টাকা হলো। কয়দিন আগেও বাচ্চা ৫-৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সামনে ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে এই দাম বেড়ে যাবে। হ্যাচারি মালিক আজকেই তাকে ম্যাসেজে দর ৩০-৩২ টাকার কথা জানিয়েছেন। এতে তার মতো বড় ব্যবসায়ী ডিলাররা বাচ্চা প্রতি এক টাকা লাভ পাবেন। আর তারা ছোট খামারিদের কাছে বিক্রি করবেন এক টাকা লাভে। কিন্তু এতে হ্যাচারি মালিকরা কত টাকা লাভ করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
এই খামারি আরো বলেন, পোল্ট্রি খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কারণ হ্যাচারি ও কোম্পানি মালিকরা যখন তখন বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেন। তাদের মনমতো আজ দাম বাড়ালো, কাল আবার কমালো। মূলত বাজারি পোল্ট্রি ব্যবসা পরিচালনাকারী বড় কোম্পানিগুলোর সাথে সাধারণ খামারিদের সমন্বয় হচ্ছে না। যেমন খামারিরা কেজি প্রতি ১২০ টাকায় বাজারে মুরগি বিক্রি করছে, কিন্তু কোম্পানি ১০০ টাকায় বিক্রি করছে। তখন সাধারণ খামারিরা বিপাকে পড়ে যান। কারণ একটা বাচ্চা ফোটাতে কোম্পানির যে খরচ হয় সেটা তাদেরই ভালো জানা। এজন্য কোম্পানি ১০ টাকা কমে বাচ্চা কিংবা মুরগি বিক্রি করলেও তাদের লোকসান হয় না। বাচ্চা ২০-২২ টাকায় কিনে ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি করতে পারলে খামারিরা মোটামুটি লাভবান হতেন।
তিনি আরো বলেন, “এই সিজনে বিশেষ করে নভেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত বাচ্চা মারা যায় বেশি। শীত বেশি পড়লে বাচ্চার সমস্যা হয়। খামারের পর্দা খুলে দিলে ঠাণ্ডা লাগে, আবার যখন পর্দা তুলে দিই তখন ভিতরে গ্যাস হয়। যখন শীত চলে যায় তখন বার্ড ফ্লুর প্রকোপ দেখা দেয়। একেক সময় একেক ধরনের রোগ দেখা দেয়। কখনও রাণীক্ষেত, গাম্বুর। তবে বার্ড ফ্লু দেখা দিলে মুরগি দ্রুত মারা যায়।”
গোপাল বলেন, দুই বছর আগেও তার খামারে তিনটি শেডে নয় হাজার মুরগি ছিল। ওই সময় বাজারে ব্যাপকভাবে বাচ্চার দর কম-বেশি হতে থাকে। তখন তার খামারে বার্ড ফ্লু দেখা দিলে কিছু মুরগি মারা যায়। পরে এক বছর আগে তিনি একটি শেড থেকে মুরগি সরিয়ে সেখানে গরুর খামার করেছেন। ১০৭ শতাংশ নিজের জমিতে ২৫ লাখ টাকায় তিনটি শেড করেছিলেন। ভেবেছিলেন, বহুতল ভবন করে খামার বড় করবেন। কিন্তু এখন অনেকটাই এই ব্যবসা গুটিয়ে এনেছেন।
বাঁশবাড়ি এলাকার আরেক পোল্ট্রি ব্যবসায়ী কেশব মণ্ডল জানান, ২০১০ সালে ব্রয়লার মুরগির খামার করেন। তখন ব্যবসা ভালো ছিল। শেড করেছিলেন চারটি। কিন্তু ২০১৭ সালে হঠাৎ মুরগির বাচ্চার দাম বেড়ে যায়। কিন্তু কেজিপ্রতি মুরগি বিক্রি করতে গিয়ে দাম কম পান। ওই সময় বার্ড ফ্লু জাতীয় রোগে তার খামারের সব মুরগি মরে গিয়েছিল। তখন প্রায় ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সেই লোকসান এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেননি।
তিনি বলেন, “এই বছর ব্যবসার পরিস্থিতি দেখবো। যদি লাভজনক হয় তাহলে করবো, না হলে খামার বন্ধ করে দেব।”
বর্তমানে তার খামারে দুটি শেডে তিন হাজার মুরগি আছে।
তিনি আরো বলেন, তার গোষ্ঠীর সঞ্জয় মণ্ডল, বাসুদেব মণ্ডল ও গোপাল মণ্ডলসহ সম্পর্কে চার ভাই পোল্ট্রি ব্যবসার সাথে জড়িত। এদের মধ্যে গোপাল মণ্ডল একসময় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি মোটামুটিভাবে ব্যবসা চালাচ্ছেন। আর সঞ্জয় মণ্ডল পুরোপুরি খামার বাদ দিয়েছেন। বাসুদেব মণ্ডল কোনোমতে ব্যবসা ধরে রেখেছেন।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, সাভারে ৪৫০ জন পোল্ট্রি ব্যবসায়ী রয়েছেন। যাদের অধিকাংশই খামারে ব্রয়লার ও সোনালি জাতের মুরগি পালন করেন। তবে লেয়ার জাতের মুরগি পালনকারী খামারির সংখ্যা অনেক কম।