সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৭:১৬ অপরাহ্ন
দোকানের বেঞ্চিটায় বসে পান খাচ্ছিলেন সোবহান মিয়া। কিছুক্ষণ পর পরই পানের পিক ফেলছিলেন মাটিতে। রাস্তা দিয়ে শুভকে যেতে দেখে ডাক দিলেন তিনি।
“তা কী খবর তোমার?”
“জি চাচা ভালো। আপনার?”
“ভালোই। পড়ালেখা শেষ কইরা আইলা? নাকি আরো বাকি?”
“শেষ, চাচা। পরীক্ষা দিয়েছি এখন রেজাল্টের অপেক্ষায়।”
“এখন তোমার ইচ্ছা কী? চাকরি বাকরি কিছু করবা না নাকি? এমন হাওয়া লাগাইয়া ঘুরে বেড়াইতাসো যে?”
পরীক্ষা শেষ করে এবার গ্রামে আসার পর এই প্রশ্নটা বহুবার শুনেছে। শুভ এবার মজা করে বলল,
“না চাচা। ব্যবসা করব। চায়ের দোকান দেবো। আমার দোকানে আপনি এসে চা খাবেন। পান আমার পক্ষ থেকে ফ্রি থাকবে।”
সোবহান মিয়া বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন,
“বেয়াদব কোথাকার।”
……
মিতু কিছুটা রেগে বলল,
“তুমি সত্যিই চায়ের দোকান দিবা?”
“তুমি কীভাবে জানলা?”
“বাবা বলল। আর কয়েকদিন পরে তো মনে হয় পুরো এলাকার মানুষ জেনে যাবে, শহর থেকে পড়ালেখা শেষ কইরা তুমি চাওয়ালা হইবা।”
শুভ হাসতে লাগল। মিতুর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। শুভ জিজ্ঞেস করল,
“আমি চাওয়ালা হলে কি তোমার খুব সমস্যা হবে?”
মিতু জানে শুভ যা বলে সেটাই করে।
যাওয়ার আগে অন্য দিকে তাকিয়ে মিতু বলে গেল,
“একজন চাওয়ালার সাথে আমার সম্পর্ক আমার বাবা কখনোই মেনে নেবে না।”
………
মিতুর কথাটাই সত্যি হলো। কয়েকদিনের মধ্যে পুরো এলাকায় রটে গেল শহর থেকে পড়া শেষ করে এসে শুভ চাওয়ালা হবে। তার দোকানে চায়ের সাথে পান ফ্রি পাওয়া যাবে।
হুংকার দিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার ব্যপারে যা শুনতাসি সেসব কি সত্যি?”
নির্বিকার ভঙ্গিতে শুভ বলল,
“কী শুনছো সেটা তো আগে বলো। ছোটবেলায় ট্রু ফলস পড়েছিলাম। ট্রু নাকি ফলস সেটা বলার আগে ওই লাইনটা দেয়া থাকে।”
বাবা ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিলেন। মা বাঁধা দিয়ে বললেন,
“করছো কী! এত বড় ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে?”
“তোমার ছেলে শুধু হাতে পায়ে লম্বা হয়েছে। আসলে তো একটা গাধা। এখন একটা ভালো চাকরি বাকরির চেষ্টা করবে তা না ওয় নাকি চাওয়ালা হবে!”
অপমানে শুভর চোখে পানি আসার উপক্রম। সে বলতে নিয়েছিল এই কথাগুলো সে নেহাতই মজার ছলে বলেছিল। কিন্তু শেষমেশ আর বলল না। এই প্রথম তার বাবা তার গায়ে হাত তুলেছে। চায়ের দোকান দেয়ার আগেই পুরো গ্রামবাসীর কাছে তার নাম এখন শুভ চাওয়ালা হয়ে গেছে। মনে মনে ঠিক করে ফেলল সে এবার সত্যিই চাওয়ালা হয়ে ছাড়বে।
………
সকালে চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে সারওয়ার হোসেন বুঝলেন অন্যদিনের চাইতে আজকের চা টা অন্যরকম লাগছে। হাসিমুখে বললেন,
“আজকের চা টা তো বেশ হয়েছে।”
“আজকের চা টা তোমার ছেলে বানিয়েছে।”
“কী বলো! ও তো আগে কোনোদিন চা বানায় নাই। এত ভালো বানালো কীভাবে?”
“তুমি আমার সাথে আসো।”
তাহেরা বেগম তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন। রান্নাঘরের ভিতরের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সারওয়ার হোসেনের। ঘরের যত কাপ ছিল সবগুলোই যেন রান্নাঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। আর সব কাপেই ভিন্ন ভিন্ন রকমের চা।
বাবা মাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসিমুখে শুভ বলল,
“বাবা আর মা, ভিতরে আসো। এখন তেতুলের চা বানাচ্ছি। এক্সপেরিমেন্ট চলছে এখনো। এটা ভালো না হলে আবার চেষ্টা করব। একবার খেয়ে দেখো।”
তাহেরা বেগম রেগে চলে গেলেন।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
“তুই এখানে কী করছিস?”
“চা বানানোর এক্সপেরিমেন্ট করছি। শুভ চাওয়ালা নামে যেহেতু পরিচিতি পেয়েই গেছি তাই ভাবছি চায়ের দোকানই দেবো।”
সারওয়ার হোসেনের আবার ইচ্ছে করল ছেলের গালে চড় দিতে। কিন্তু একবার চড় দিয়েই তার মন খচখচ করছে তাই আবার চড় দেয়ার সাহস করলেন না।
………….
কয়েকদিনের মধ্যে দেখা গেল শুভ বেশ উৎসাহের সাথে দোকান ভাড়া নেয়ার তোড়জোড় করেছে। শেষমেশ একটা দোকান পেয়েও গেল। খবরটা সারওয়ার হোসেনের কান পর্যন্ত যেতে দেরি হলো না।
“শুনলাম তুমি দোকান ভাড়া নিচ্ছো। তা এত টাকা পেলে কোথায়?”
“বাবা, শহরে থাকতে টিউশনি করাতাম। এত বছরে অনেক টাকা জমেছে। সেটা দিয়েই আপাতত চলে যাবে। এরপর ব্যবসা যখন….”
“জাস্ট শাট আপ। তুমি কী আমাদের মান সম্মানের কথাও ভাববে না?”
“আমি তো চুরি ডাকাতি করছি না, বাবা।”
সারওয়ার হোসেন আর কথা বাড়ালেন না। রাগে তিনি কাঁপছেন। শুভ, বাবা আরো কিছু বলবে নাকি সে চলে যাবে বুঝতে পারছে না।
………..
দোকানের নাম রাখা হলো শুভ চাওয়ালা। সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে তার চা বানানো দেখছে। সাথে পান, বিস্কিট আরো যা যা থাকা দরকার সেসবও আছে। একজন চা শেষ করে বলল,
“শুনলাম তুমি নাকি চায়ের সাথে পান ফ্রি দিবা?”
শুভ হাসিমুখে একটা পান দিলো লোকটিকে।
“এমনে দিতাসো ক্যান? পান, সুপারি, চুন এসব কই?”
শুভ মুচকি হেসে বলল,
“পান ফ্রি দেবো বলেছিলাম। সুপারি, চুন, খয়ের এসব ফ্রি দেবো সেটা তো বলিনি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। টাকা রাইখো। ভালো কইরা একটা পান বানাইয়া দাও।”
………
এক মাসের মধ্যে ভালোই বেঁচাকেনা হলো তার দোকানে। দোকানে বসে বয়স্ক লোকেরা দেশ, সমাজ, রাজনীতি এসব নিয়ে আলোচনা করে। শুভ মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনে। মাঝে মাঝে নিজের মতামত দেয়। তার মনে হতে থাকে জীবনটা খুব একটা খারাপ না।
গ্রামে ‘শুভ চাওয়ালা’ নামেই সে পরিচিত এখন।
……..
“আঙ্কেল, শুভর ফোন বন্ধ কেন? ওর কোনো খোঁজ খবর পাচ্ছি না।”
সারওয়ার হোসেনের ফোনে কল করেছে শুভর এক বন্ধু।
“ওরে কিছু বলা লাগব?”
“হ্যাঁ আঙ্কেল। আমাদের তো আজকে রেজাল্ট দিয়েছে। সেটাই জানানোর জন্য খুঁজছিলাম।”
“তুমি একটু ওর রেজাল্টটা দেইখা দিবা?”
“আচ্ছা আঙ্কেল, আপনি ওর রোল আর রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটা দেন।”
………
রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরে শুভ। এত রাত পর্যন্ত বাবাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো সে। সারওয়ার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তোমার যে রেজাল্ট দিয়েছে তুমি জানো?”
“না, বাবা।”
শুভ এই চায়ের দোকান নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে এই খবরটাও রাখেনি। এমনকি রেজাল্টটা এখন জানার চেষ্টাও করছেনা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছ।”
শুভ সেরকমই নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
“ও আচ্ছা। এই খুশিতে এক কাপ চা বানিয়ে আনি?”
রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল সারওয়ার হোসেনের। এমন ভালো সংবাদ পাওয়ার পরেও বাবার এই রাগের কারণ খুঁজে পেলো না শুভ।