মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৯:১৫ অপরাহ্ন
:আফতাব চৌধুরী:
রমযান ও সিয়াম এ দুটি পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আরবী শব্দ। সত্তম ধাতু প্রত্যয় করে সিয়াম, রময ধাতু হতে রমযান, এদের আভিধানিক অর্থ, যথাক্রমে সিয়াম অর্থে বিরত রাখা আর রময অর্থে দহন ও দগ্ধ করা। মানুষের অবচেতন মনের অন্তরালে কাম-ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ লালসা, পরশ্রীকাতরতা, যাবতীয় অন্যায় প্রবণতা সকলের অলক্ষে তিলে তিলে যা দানা বাঁধে ও সঞ্চিত হয় রমযানের সিয়াম সাধনার প্রভাবে এ সকল জ্বলে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে হৃদয় মন মলিনতামুক্ত ও নির্মল হয়ে চিত্তশুদ্ধি ঘটে। সিয়াম বা কৃচ্ছসাধনা মানুষকে দিবাভাগে পানাহার ও যৌনচার হতে সম্পূর্ণ বিরত রাখে, উল্লেখিত কারণে সিয়াম ও রমযান এর অনুরূপ নামকরণ হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের বিধান শাস্ত্রগুলো পর্যালোচনা করলে এ সত্য অনায়াসেই উপলব্ধি করা যায় যে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টির কাছ থেকে যেটা তাঁর সর্বাধিক আশা ও কাম্য তা হল, তাঁর গুণকীর্তন করুক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ অধিকাংশ মানুষই মায়া মোহের জালে ও লোভ লালসার প্রলোভনে প্রবঞ্চিত ও বিভ্রান্ত হয়ে আত্মবিস্মৃত হয়, তার সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পথ হতে বিচ্যুতি ঘটে। তাই সৃষ্টির সেরা বিভ্রান্ত মানুষের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক তথা সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশে সকল ধর্মের শাস্ত্রে নানা রূপ বিধান দেওয়া হয়েছে- সিয়াম সাধনা ও উপবাস ব্রত ইহাদের অন্যতম।
সব ধর্মেরই মূল লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। বঙ্গাহীন দুর্দমনীয় কু-রিপুকে সংযত ও শালীন করে একনিষ্টভাবে বিশ্বস্রষ্টার নাম স্মরণে ও নিত্য বন্দনায় মগ্ন ও মশগুল রাখা ও সৃষ্টির নিষ্কাম সেবায় আত্মনিয়োগ করে সে চির মহান পরমাত্মার সঙ্গে একাত্ম-অখন্ড হয়ে বিলীন হয়ে তাঁর সন্তুষ্টি সান্নিধ্য লাভ করে নির্বাণ ও মুক্তি কামনা।
ফলকথা যা স্রষ্টার প্রতি ভক্তি ও সৃষ্টিকে প্রেম, মুখে নাম ও হাতে কাম এটিই সব ধর্মের সার কথা। দীর্ঘ এক মাস যাবৎ কঠোর নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে রুটিন মোতাবেক রমযানের কৃষ্ণসাধনার ফলশ্রæতি মানুষের সহজাত সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো সঞ্জীবিত হয়ে সহমর্মী হয়, সৃজনশীল চেতনার উম্মেষ হয়ে মহৎ জনহিতকর ও কল্যাণকর কর্মে মানুষ উদ্বুদ্ধ ও তৎপর হয়। রোজদার পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে সহজেই ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা উপলব্ধি করে অন্নক্লিষ্ট, বুভুক্ষ পীড়িত আর্ত মানবতার প্রতি দয়ার্দ্র হয়ে তাদের দুঃখ মোচনে তৎপর হয়। কেবলমাত্র পানাহার ও যৌনচার হতে দিবাভাগে বিরত থাকার নামই রোজা পালন নয়, বরং যাবতীয় ইন্দ্রিয় সংযমের নামই রোজা পালন। এ প্রসঙ্গে রোজাদারদের উদ্দেশে প্রিয়-নবী হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর সতর্ক বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, যে রোজাদার, রোজার আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখল না, রোজা অবস্থায় মিথ্যাচার ও হঠকারিতা বর্জন করল না, এরূপ রোজা মহান আল্লাহ এর দরবারে অনভিপ্রেত। অতএব এরূপ রোজাদারের অনর্থক ক্ষুধা তৃষ্ণার কষ্টসহ্য তাঁর কাম্য নয়। (আল হাদীস)
পবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ এর একই সমার্থবোধক উক্তি, তিনি বলেছেন-তোমাদের প্রতি রমযানের রোজার বিধান দেওয়া হল, একান্ত ভাবে অবশ্যই পালনীয় বাধ্যতামূলক কর্তব্য করা হল, যেন তোমরা আমার প্রতি ভয়, ভক্তি ও শ্রদ্ধাবনিত চিত্ত হয়ে সংযমী হও। (মর্মার্থ আল কুরআন ২ঃ১৮৩)
বলা বাহুল্য প্রত্যেক ধর্মেই সিয়াম সাধনা ও উপবাস ব্রত পালনের কমবেশী বিধান দেওয়া সত্তে¡ও অধিকাংশ লোকই এ বিষয়ে সচেতন ও সজাগ নয়। অথচ ফকির দরবেশ পীর মুর্শিদ নবী রসুল, আউলিয়া আম্বিয়া ও মুনি-ঋষিগণ, প্রত্যেকেই তাদের সাধন ভজন মার্গে সাফল্য অর্জনের জন্য উপবাস ও রোজা পালন করে, কৃষ্ণসাধন করে অধ্যাত্ম সাধনায় সাফল্যমন্ডিত হয়েছেন। বলাবাহুল্য এর অনুশীলনের অভাবে মানুষ তার মনের উপর হতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ক্রমশ ধর্মান্ধ, জ্ঞানান্ধ ও স্বার্থান্ধ হতে চলেছে।
অবএব বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু সমাজ জীবনকে নৈতিক অবক্ষয়মুক্ত করতে হলে, আসুরিক প্রবৃত্তি-পরায়নতাও স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রতিরোধ করতে সিয়াম সাধনা ও উপবাস ব্রত পালনের তথা অধ্যাত্ম ও কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য ও অনস্বীকার্য। সাংবাদিক -কলাস্টি।১৩. ০৩. ২০২৪