শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন
। মুজিবুর রহমান মুজিব।
মানুষের জন্ম ও মৃত্যোর মধবর্ত্তী অন্তবর্তী কালীন সময়ের নাম জীবন। মানবজীবন খুবই ক্ষনস্থায়ী। অনির্ধারিত। আমাদের মহান ¯্রষ্টা ও প্রতিপালক দো’জাহানের খালিক মালিক সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালা আসমানী কিতাব আল কোরআনে বলেন- “কুল্লুন নাফসীন জ্যায়িকাতুল মউত”। জগতের সকল প্রাণীকেই মৃত্যোর স্বাদ গ্রহন করতে হবে। আল্লার এই আইনের ব্যতিক্রম নেই ব্যত্যয় নেই। মহান মৃত্যো চীরন্তন-অবধারিত ও শ্বাস্বত সত্য হলেও মৃত্যোকে সহজে মেনে নিতে পারেন না মূর্দার স্বজন-শুভাকাংখীগণ। আকুল কান্নায় ব্যাকুল হন। অসময়ের আকস্মিক মৃত্যো-অসহনীয়-বেদনাদায়ক। এমনি অসময়ে আকস্মিক ভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চীরতরে না ফেরার দেশে চলে যান এই জন পদের সমাজ রাজনীতি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গঁনের প্রিয় মুখ ষাটের দশকে পাক সামরীক স্বৈর শাসক আয়ূব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আপোষহীন ছাত্র নেতা, একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ট সংঘটক স্বাধীনতা উত্তর কালের জেলা আওয়ামী লীগের সুদক্ষ সম্পাদক জননেতা আলহাজ্ব আব্দুল অদুদ। দুই হাজার আট সালের দশই অক্টোবর সুঠাম শরীরের অধিকারী, সুবেশি, সুশৃংঙ্খল জীবন-যাপনকারী অকৃতদার আব্দুল অদুদ তখন মাত্র ষাটের কোঠায়। ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংঘটক আব্দুল অদুদের কোন অসুখ-বিসুখ রূগ বালাই ছিল না। গ্রহ্ণ সুহৃদ এবং অসম্ভব রকমের চিন্তাবিদ আব্দুল অদুদ ব্রেন ষ্টোক আক্রান্ত হয়ে এই দিন ইন্তিকাল করে ছিলেন। গেল দশই অক্টোবর মরহুম আলহাজ্ব আব্দুল অদুদের ত্রয়োদশ মৃত্যো বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর পারিবারিক উদ্যোগে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া দূরুদের আয়োজন করা হয়ে ছিল। এগারো তারিখ সন্ধ্যায় আমার রসূলপুর হাউসের বাসায় আসে মরহুমের প্রিয় ভ্রাতস্পুত্র চেম্বার পরিচালক ¯েœহভাজন খায়রুজ্জামান শ্যামল। তাঁর মরহুম পিতা এ জেলার বিশিষ্ট বিজ্ঞ জন মরহুম আলহাজ্ব কামরুজ্জামান-কমরু ভাই সাহেব আমার খালাত সম্মুন্ধি। তিনি আমার একজন শ্রদ্ধেয় গুরুজন এবং আমি তাঁর একান্তই ¯েœহভাজন ছিলাম। পিতৃ মাতৃহীন ¯েœহভাজন শ্যামলকে নিয়ে আমি ও আমার সহধর্মিনী মনোওয়ারা রহমান ডাইনিং টেবিলে বসাই। মরহুম আলহাজ্ব কামরুজ্জামান এবং মরহুম আলহাজ্ব আব্দুল অদুদ এর সঙ্গেঁ আমি একাধিক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। কথায় কথায় শ্যামল জানায় তাঁর মরহুম বাপ-চাচা আলহাজ্ব কামরুজ্জামান এবং আলহাজ্ব আব্দুল অদুদ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মরহুম আব্দুল অদুদ এর মৃত্যো বার্ষিকী অন্যান্য বৎসর এর মত এবারও পালন করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ধর্মীয় ও সমাজ সেবা মূলক খাতে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
খায়রুজ্জামান শ্যামল জানাল মরহুম জননেতা আলহাজ্ব মোঃ আব্দুল অদুদের সম্মান ও স্মরনে তাঁর ত্রয়োদশ মৃত্যো বার্ষিকী উপলক্ষে বৃটেন প্রবাসী কমিউনিটি নেতা আমার প্রিয়ভাজন মকিচ মনসুর এর উদ্যোগে একটি ভার্চুয়াল সেমিনার এর আয়োজন করা হয়েছে তেরোই অক্টোবর রাতে আমাকে আমার বাসায় অবস্থান করতঃ সংযুক্ত হয়ে স্মৃতি চারন মূলক বক্তব্য রাখতে হবে। বৃটেনের উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে আমার কাছে এই দাবী জানানো হয়েছে। বৃটেন প্রবাসী প্রিয় উদ্যোক্তাদের এই মহতি আয়োজন এর ধন্যবাদ জানিয়ে নীতিগত সম্মতি ও বক্তব্য প্রদানের অঙ্গীকার ও ব্যক্ত করলাম। বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির এই অগ্রগতিতে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। শ্যামলকে আমি এতদ্ সংক্রান্ত কিছু পরামর্শও দিলাম, সংযুক্ত হতে কথা বলতে আমার কোন অসুবিধা হবার কথা নয়, এখনও সাম্প্রতিক কালে-সেলফ কোয়ারেন্টাইনে-আছি। বাসায় “ওয়াই ফাই”- সংযুক্তি আছে। তাছাড়া আমার একজন মরহুম আত্মীয়ের প্রতি সপরিবারের সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব ও বটে।
তেরোই অক্টোবর সন্ধ্যা রাত। লন্ডনের সঙ্গেঁ ভার্চুয়াল সংযুক্ত হতে আমাকে বেগ পেতে হয় নি। আমার একমাত্র পুত্র সন্তান মিনহাজ রহমান আমার মোবাইল দিয়েই বৃটেনে বসবাসরত কর্ম চঞ্চল সমাজ সেবি আরেক নিবেদিত প্রাণ মুজিব সৈনিক মকিছ মনসুর এর সঙ্গেঁ সংযুক্ত করে দিল। দেশ থেকে অনান্যদের সাথে সংযুক্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক প্রবীন কর আইনজীবী বন্ধুবর মাহমুদুর রহমান। উদ্যোক্তা ও সংঘটক মকিছ মনসুর এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট জন মরহুম আব্দুল অদুদ এর কর্ম ও জীবন দর্শনের আলোচনা করতঃ উদ্যোক্তাগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
নির্লোভ রাজনীতিবিদ সহজ, সরল ও সৎ মানুষ আব্দুল অদুদ তাঁর মৃত্যোর ত্রয়োদশ বার্ষিকীতেও সমুজ্জল আমাদের স্মৃতিতে অ¤øান।
পাকিস্তানী স্বাধীনতার উষালগ্নে মৌলভীবাজার সদর থানাধীন উত্তর মুলাইম ছালামতপুর গ্রামে শিক্ষিত সম্ভান্ত স্বচ্ছল মুসলিম পরিবারে আব্দুল অদুদ এর জন্ম। তাঁর পিতা মৌলভী আজাদুর রহমান অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসাবে বৃটিশ ভারতের শেষ ভাগে মৌলভীবাজার গভ.হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করে ভালো ফলাফলের কারনে আসাম সরকারের অধীনে সরকারী চাকরি লাভ করেন। তখন এতদাঞ্চলে কলেজ না থাকার কারনে উচ্চ শিক্ষা লাভের কোন সুযোগও ছিল না।
শিক্ষিত পরিবারের সু-সন্তান আব্দুল অদুদ বাল্য কৈশের কাল থেকেই পারিবারিক পরিবেশ এর কারনে লেখাপড়া, খেলাধুলা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ও সমাজ কর্মের প্রতি উৎসাহী ছিলেন। জ্যৈষ্ট ভ্রাতা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান পাক আমলের মধ্যভাগের কমার্স গ্রেজুয়েট, শিক্ষাবিদ, জন প্রতিনিধি ও ক্রীড়াবিদ ছিলেন। অপর জ্যৈষ্ট ভ্রাতা আলাউর রহমান পাকিস্তান নেভির পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। কনিষ্ট ভ্রাতা আব্দুল মজিদ ছাত্র লীগ নেতা এবং ক্রীড় ও সাংস্কৃতিক সংঘটক ছিলেন। আমার মত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সদস্য পদ এর মাধ্যমে বাঙ্গাঁলি জাতীয়তা বাদের অনুসারি আব্দুল অদুদু এর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ আমার মতই ছাত্রলীগ দিয়ে তাঁর ছাত্র রাজনীতি শুরু। ষাটের দশকের সেই কঠিন সময়ে নিখাদ দেশ প্রেম, অপূর্ব সাংঘটনিক দক্ষতা, বাগ্মিতা এবং কর্মি বাৎসল্যের কারনে দলের নেতৃত্ব পেয়েছেন মহকুমা ছাত্রলীগের সম্পাদক হয়েছেন। একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সংঘটক হিসাবে বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতা উত্তর কালে মূল দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি নির্ব্বাচিত হয়ে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কৃতিত্ব, মহাত্ব ও বাহাদুরি হল এই তাঁর মধ্যে কোন রাজনৈতিক দুদুল্য মানতা সিদ্ধান্ত হীনতা ছিল না, তিনি তাঁর নেতাও দলের প্রতি ছিলেন, নিঃশর্ত অনুগত, তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায়, রাজনৈতিক বিভক্তি-বিভাজন ও বিভ্রান্তির মাঝে তিনি সর্বদাই ছিলেন মূল ধারা বঙ্গঁবন্ধুর অনুসারি। কোন ভয় ভীতি লোভ লালসা তাঁকে নীতি চ্যোত করতে পারেনি, তিনি আজীবনই ছিলেন একজন নির্লোভ-নির্ভীক মুজিব সৈনিক। একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে তিনি ছিলেন মহত ও সৎ। সাম্প্রতিক কালে রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, দূর্নীতি, স্বজন প্রীতি, পদ বানিজ্য, বানিজ্যায়ন-দূবৃত্তায়ন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও তিনি ছিলেন একজন মিঃ ক্লিন।
ভ্রষ্ট ও নষ্ট রাজনীতির কলংকের কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি কারো “গড ফাদার” ছিলেন না, কিংবা তাঁর কোন “কেডার” ছিল না, তিনি কোন কেডার বাহিনী পুষতেন না, কেডার প্রথায় বিশ্বাস করতেন না। অকৃতদার হলেও তিনি বয়োঃকনিষ্ট কর্মিগণকে সহোদরের মত-সন্তানের মত ¯েœহ মমতা করতেন। পেশাগত ভাবে তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর পেশাগত জীবনেরও তাঁর সততার সুনাম আছে। মৌলভীবাজার চেম্বার এর সভাপতি হিসাবে তিনি আন্তরিকতা ও কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি বনিক সমিতির সময় থেকে সংস্থার আইন উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। এখানেও তাঁর সঙ্গেঁ কাজ করে দেখেছি পেশার প্রতি তিনি কত আন্তরিক মানুষের অধিকারের প্রতি তিনি কত দায়িত্ব বান।
তাঁর সঙ্গেঁ আমার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের সেই বাল্য কৈশোর কাল থেকে। লেখাপড়া রাজনীতি বয়স সংক্রান্ত ব্যাপারে আব্দুল অদুদ আমার কিঞ্চিত কনিষ্ট ছিলেন। তিনি আমাকে আন্তরিক ভাবে মুরব্বি মানতেন। তাঁর সঙ্গেঁ আমার আত্মীয়তার সূত্র একাধিক। আমার পিতা এবং আমার বৈবাহিক সূত্রে তিনি আমার পরমাত্মীয় ও মুরব্বি। আমি তাঁকে মনে প্রাণে মুরব্বি মানতাম। আমরা একে অন্যের প্রতি মস্তক উচিয়ে উচ্চ বাচ্চ করিনি। আমাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় মত পার্থক্য হলেও মন মালিন্য হয় নি। তিনি ছিলেন উদার গণতন্ত্রী। মুক্ত মনের মুক্ত মানুষ। বাঙ্গাঁলি জাতীয়তাবাদের অনুসারি আব্দুল অদুদ ছিলেন একজন খাটি বাঙ্গাঁলি আপাদ মস্তক সাচ্চা ঈমানদার মুসলমান-ধর্ম প্রাণ মুসলমান। কলেজ সংলগ্ন আজাদাবাদ এলাকায় তাঁদের বিশাল পৈত্রিক বাসা বাড়ি। তাঁর পৈত্রিক ভিটায় তাঁর অংশে তিনি বাসা বাড়ি দালান কোঠা বানান নি। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এই ভূ-সম্পত্তি ঈমানদার মুসলমান আলহাজ্ব আব্দুল অদুদ মসজিদের নামে দান করে গেছেন। আলহাজ্ব মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সাহেবের বাসা বাড়ির সামনে দৃষ্টি নন্দন স্থাপনার আকর্ষনীয় আজাদাবাদ জামে মসজিদটি তাঁর ভূমিতে নির্মিত। তিনি তাঁর ভাগের ভূমিতে নিজে বসবাসের জন্য বাসাবাড়ি নির্মান না করে আল্লাহর এবাদতের জন্য একটি এবাদত খানা নির্মানের সুযোগ দিয়ে চাই চাই খাই খাই এবং দখল কালচারের মাঝে একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। ত্যাগের এই উদাহরণ থেকে আমাদের বর্ত্তমান প্রজন্ম অনেক কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।
উত্তর মুলাইম মল্লিক সরাই মাদ্রাসা সংলগ্ন দিঘির উত্তরাংশে এলাকা বাসির গোরস্থানে রাজনীতিবিদ আব্দুল অদুদ চীর শয়ান শায়িত। বুনো ঘাস আর ছোট খাটো ঝুপ জঙ্গঁলে ছেয়ে গেছে এলাকাটি। আমার গ্রামের বাড়ি রসূলপুর যেতে পথেই পড়ে তাঁর কবর স্থানটি। আগে বাড়িতে কম যেতাম। এখন ঘন ঘন যাই, কারন আমার ও এখন যাবার বেলা, আমি ও এখন জীবন সায়াহ্নে। আমার পিতা-মাতার কবরের পায়ের কাছে আমার কবরের জায়গা ঠিক করে রেখেছি-যেখানে আমি চীর শয়ানে শায়িত হব।
মরহুম আলহাজ্ব আব্দুল অদুদ এর কবরের পাশে গেলেই মনের আয়নায় ভেষে উঠে তাঁর মুখচ্ছব্বি। মাঝারি উচ্চতায়, ফর্সা চেহারার, মাথায় আর্মি কাটের ছোট চুল, পরিপাটি পোষাকের গোল বাটা মুখি আব্দুল অদুদের মুখে এক চিলতে মুচকি মিষ্টি হাসি লেগে থাকত সব সময়। তাঁর উজ্জল স্মৃতি এখনও স্মৃতিতে অ¤øান। আমি প্রায়ই তাঁর কবর জিয়ারত করি, রুহের মাগফিরাত চাই। সহজ-সরল মহৎ মানুষ, সৎ মানুষ আলহাজ্ব আব্দুল অদুদের ত্রয়োদশ মৃত্যো বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাই, মহান মালিক তাঁর বেহেশত নসীব করুন এই মোনাজাত করি।
[ষাটের দশকে ছাত্র লীগ নেতা। মুক্তিযোদ্ধা। কলামিষ্ট। সাবেক সভাপতি মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব।]