শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৮ অপরাহ্ন
ইউক্রেন নিয়ে পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কের খুব দ্রæতই অবনতি হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড়ো তিনটি সমস্যার একটি হচ্ছে ইউক্রেন সমস্যা । দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্যালেস্টাইন সমস্যা। যুগ যুগ ধরে এ সমস্যা জিয়ে রাখা হয়েছে আর হাজার হাজার নিরহ প্যালেস্টাইনি মুসলমানদের হত্যা করে চলেছে বর্বর ইহুদিরা, সহযোগিতা করে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী পশ্চিমারা। ইহুদিরা মানুষ খুন করা ছাড়াও তাদের ঘর-বাড়ি, মসজিদ- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। অথচ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলতে গেলে এসব বন্ধে নেই কোন দৃঢ় পদক্ষেপ। মাঝে মধ্যে দু’একটি সিন্ধান্ত নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়না এতে বরং ইহুদিরা আরো ব্যাপরোয়া হয়ে উঠে মুসলিম নিধনে। তৃতীয় সমস্যা রোহিঙ্গা সংকট- পার্শ¦বর্তী দেশ মায়ানমারে দীর্ঘদিন থেকে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যা করে চলেছে সে দেশের সরকার সেনাবাহিনী। গেল ক’বছর আগে ১১/১২ লক্ষ রোহিঙ্গাদের পৈত্রিক বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করে তাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে। কত রোহিঙ্গাদের তারা যে হত্যা করেছে তার কোন হিসাব নেই। জানিনা কেন জাতিসংঘ বা বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ এ ব্যাপারে নিরব ভূমিকা পালন করছে। এদিকে ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সংকট যা আমেরিকার জন্য বেশি ব্যাপক এবং বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মার্কিন প্রশাসনের জন্য রাশিয়ার বøাদিমির পুতিন একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছেন। পুতিনকে ক্ষমতা থেকে বিভাজনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা একযোগে কাজ করছে যাতে দেশের অভ্যন্তরে পুতিনের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে এবং দেশের অভ্যন্তরেই পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহ শুরু হয়। কারণ মার্কিনদের ভয় আসন্ন নির্বাচনে পুতিন যদি আবার প্রার্থী হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে স্নায়ুযুদ্ধের যে দেয়াল মার্কিনরা নির্মাণ করছে তা হয়তো ভেঙে খানখান হয়ে যাবে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করেছেন যে, ইউক্রেন সমস্যাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বøাদিমির পুতিন সরকারের পতন ঘটাতে চায়। তিনি আরও বলেছেন, ইউক্রেন সংকটের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মস্কোর বিরুদ্ধে যত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাশিয়ার জনগণকে পুতিনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলা যাতে পুতিন সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চুপ করে বসে নেই। তিনিও কথা বলেছেন সমান তালে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসব বক্তব্য দিয়ে মস্কোর আন্তর্জাতিক অপরাধের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্বাধীন দেশ ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়াকে জোরপূর্বক দখল করে এবং দেশটির পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্রমাগত সমর্থন ও সাহায্য সহায়তা দিয়ে মস্কো আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন করেছে।
খেসারত তাকে দিতেই হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র জন কেরির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে চিৎকার করে বলেছেন যে, একজন জনপ্রিয়হীন প্রেসিডেন্ট আক্রমণাত্মক কর্মসূচি নিয়ে রাশিয়ার জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করছেন। সেই লক্ষ্যে তিনি অনেকটা সরল হলেও হতে পারেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে তিনি এজন্য আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনকারী এবং একজন অপরাধী হিসাবেই তিনি বিবেচিত হবেন।
অন্যদিকে, পুতিনও বসে নেই। তিনিও পশ্চিমা বিশ্বকে এই বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে চলেছেন যে, ক্রেমলিনের সামাজিক মর্যাদা ও সামরিক শক্তিকে মার্কিনিরা সহ্য করতে পারছেন না। ইউক্রেনে মস্কোর নীতি যথার্থ বলেই তিনি দাবি করেন। যুদ্ধের শুরু থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বতন্ত্র নির্বাচনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া যদিও ইউক্রেন সরকার ও তাদের সমর্থক পশ্চিমা গোষ্ঠী ওই নির্বাচনকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বøাদিমির পুতিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এই নির্বাচনটিকে শুধু স্বীকৃতিই দেননি, দিয়েছেন এক নতুন মাত্রা। তিনি বিচ্ছন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে ‘নতুন রাশিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ এই অংশ যে ইউক্রেনেরই অংশ মস্কো তা আর স্বীকার করছে না। অর্থাৎ ইউক্রেনের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন যে-কোনো সময়ের তুলনায় অবনতিশীল।
১৯৯১ সালে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর বিশাল কমিউনিস্ট দেশটি থেকে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এর মধ্যে ইউক্রেন হচ্ছে অন্যতম। তারপরও বিশ্বে মূল সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরাট অংশ নিয়ে গঠিত। বর্তমানে রাশিয়ায় বহু দলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, পুতিন বেশ কয়েক বছর যাবৎ দেশের রাজনীতির প্রধান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবেইে প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বব্যাপী রয়েছে তার বেশ দাপট। এর আগে পুতিন দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে সংবিধানের সীমাবদ্ধতার কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে পুনরায় ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসেন। তবে পুরো সময়ই তিনি রাশিয়ায় শক্তিশালী ব্যক্তি হিসাবে কাজ করেছেন।
পুতিন মূলত জাতীয়তাবাদী নেতা। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের হারানো গৌরব ও প্রাধান্য বিশ্ব রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। তিনি বহুলাংশে সফলও হচ্ছেন। বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়াকে তিনি আবারও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। বেশ কিছু বিষয়ে আমেরিকা ও তার মিত্রদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। আর ইউক্রেন নিয়ে তিনি আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। বর্তমানে ইউক্রেন নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা কিন্তু মারাত্মক বিপর্যয়ের পূর্বাবাস যা বলা যেতে পারে। গত বছরের শুরুতে পশ্চিমা সমর্থক গোষ্ঠীদের বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনের ফলে সেখানে রুশপন্থী সরকারের পতন ঘটে। এরপর থেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রভাব কমতে থাকে কিন্তু রাশিয়া এর প্রতিশোধ গ্রহণ করে ক্রিমিয়া দখল করে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ইউক্রেন প্রসঙ্গে রাশিয়াকে আর আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ভঙ্গ করতে দেওয়া হবে না। এদিকে নতুন করে যুদ্ধ হলে ব্রিটেন তার জন্য সজাগ রয়েছে। ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী বলেছেন, এখনই রাশিয়াকে থামানো না গেলে ভবিষ্যতে ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য বিপর্যের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার তৎপরতাকে বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিসবেনের সম্মেলনে চীনের নেতৃত্ব নিশ্চুপ থাকলেও কয়েকদিন আগে চীন অনুষ্ঠিত এপেক সম্মেলনের সময় পুতিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন-পিং বলেছেন, চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক এখন যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি পরিপক্কতা লাভ করেছে। সেখান থেকে এখন উভয় দেশকেই ফসল ঘরে তুলতে হবে। সা¤প্রতিক সময়ে চীন রাশিয়ার সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুনজরে দেখছে না।
এ বছরের শুরুতেই রাশিয়া থেকে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি ক্রয়সহ দু’ডজনেরও অধিক পারস্পারিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীন ও রাশিয়া। রাশিয়া ও চীনের দুই শীর্ষ নেতা দু’বছরে অন্তত দশবার মিলিত হয়েছে। সুতরাং ইউক্রেন বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ইস্যুতে চীনের অবস্থান শক্ত ভেবে চরম দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে মার্কিনিরা। রাশিয়ার বিদেশনীতি সম্পর্কিত ডুমা (পার্লামেন্ট) কমিটির প্রধান বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা জন্মেছে, বিশ্ব নেতৃত্বের আসন বহাল রাখতে অদূর ভবিষ্যতে তাদের চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। তার জন্য ইউরোপের সংহতি আমেরিকাকে ধরে রাখতে হবে। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে আরো শক্তিশালী করার জন্য পূর্বদিকে (ইউক্রেন-জর্জিয়া) স¤প্রসারণ করা প্রয়োজন। লক্ষনীয় এরই মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বহুদূর গড়িয়েছে, ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ন্যাটোসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ইউক্রেনের পক্ষে এবং চীন, ইরান প্রভৃতি দেশ রাশিয়ার পক্ষে তাদের সমর্থন ও সহযোগীতা বাড়িয়ে চলেছে।
ন্যাটোর ক্রমশ পূর্বদিকে বিস্তার, বাল্টিক, কৃষ্ণসাগরসহ কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে রাশিয়া ও চীনের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর কৌশল এখন আর কারো অজানা নয়। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর প্রায় সব দিক থেকেই পশ্চিমারা চীন ও রাশিয়াকে ঘিরে ফেলেছে। এখন ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটভুক্ত করতে পারলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়। আর সে কারণেই নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করেছে এবং ইউক্রেনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিক- কলামিস্ট।